জালাল উদ্দিন ॥ সিলেট বিভাগ একটু অন্যরকম বটে। পাহাড়, চা বাগান আর বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বসবাস এই বিভাগেই। হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলা একটি পাহাড় বেষ্টিত চা বাগান অধ্যুষিত বিভিন্ন উপজাতির বসবাস এর এক অনন্য স্থান। এই উপজেলায় অসংখ্য চা বাগান আছে, তার মাঝে অন্যতম, লালচান চা বাগান। যেখানে বসবাস করেন- উপজাতি হিসেবে সাঁওতাল, ভূমির, মুন্ডা, বাউরি, রায়, ব্যানার্জি, নাগপুরি, বাগতি, সবর, সম্প্রদায়। আর এ বাগানেই গড়ে উঠেছে আলোর স্বপ্নের বাতিঘর- বঙ্গবন্ধু উচ্চ বিদ্যালয়। বাগানের একদল উদ্যমী যুবক ও চা শ্রমিকের সন্তান, যারা কিনা বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া, তারাই গড়ে তুলেছেন তাদের স্বপ্নের এই প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৮ সাল থেকে শুরু করেছেন শিক্ষা কার্যক্রম। কখনো খোলা আকাশের নিচে, কখনওবা নাচঘরে, কখনো বা কারো বাড়ির বারান্দায়, এমন করেই শুরু করেছিলেন কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পাঠদান কার্যক্রম। বাগান থেকে উচ্চ বিদ্যালয় অনেক দূরে, মাইলের পর মাইল হেঁটে অনেক ছেলে-মেয়েরাই পড়ালেখা করতে চায় না, আর সে কারণেই উদ্যমী প্রাণচঞ্চল একঝাঁক শিক্ষার্থী, যারা কিনা বাগানেরই সন্তান। তারাই শুরু করে দিলেন স্বপ্নের বাতিঘরের যাত্রা। বাগানের শ্রমিকদের জনপ্রতি ১০০ টাকা করে অনুদানের মাধ্যমে প্রথমদিকে ২ লক্ষ টাকা ফান্ড তৈরি করে শুরু করা হয় কার্যক্রম। বাগান পঞ্চায়েতের দাবির প্রেক্ষিতে বাগান কর্তৃপক্ষ তাদেরকে দান করেছেন একশ শতক জায়গা। সেই জায়গার উপরে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আবু তাহের, উপজেলা প্রশাসন, ইউনিয়ন চেয়ারম্যান সময়ে সময়ে দিয়েছেন বরাদ্দ। গড়ে উঠেছে স্কুলের নিজস্ব ভবন। সম্প্রতি স্কুলটি ঘুরতে গিয়ে দেখা যায়, কোমলমতি একদল চা শ্রমিকের সন্তানেরা পাঠ গ্রহণ করছেন। এই বাগানের সন্তান, বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া শিক্ষার্থীরা, বিনা পারিশ্রমিকে পাঠদান করে যাচ্ছেন, নিরলস ও নির্মোহভাবে। চারিদিকে সবুজের সমারোহ। পাহাড় টিলা এবং চা বাগান। সে এক অপরূপ দৃশ্য। নীল আকাশের নিচে দিগন্ত জুড়ে খোলা মাঠ। চা-বাগানের কোল ঘেঁষেই ঠায় দাঁড়িয়ে আছে- বঙ্গবন্ধু উচ্চ বিদ্যালয়। কি অপরূপ, কি অসাধারণ। মন ভুলিয়ে যাওয়ার মত একটি স্থান। সেখানেই শ্রমিকরা অন্তরাত্মায় লালন করছেন বঙ্গবন্ধুকে। তার আদর্শকে। তাদের কষ্টার্জিত অর্থে গড়ে তোলা এই প্রতিষ্ঠানের নামকরণ এর মধ্য দিয়েই বোঝা যায়, বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার গভীরতা।
চা শ্রমিকদের সন্তানেরা, কষ্ট করে, পড়ালেখা করে, এখন তারা স্বপ্ন দেখছেন, পরবর্তী প্রজন্মকে নিয়ে যাবেন এক উচ্চতর জায়গায়। সে কারণেই নিজ উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন বঙ্গবন্ধু উচ্চ বিদ্যালয়। চা শ্রমিক অনিল বারই কে বঙ্গবন্ধু নামকরণ এর কথা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন- আমরা বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসি, ভালোবাসি আওয়ামী লীগকে। আমাদের জন্য বঙ্গবন্ধুই একমাত্র আদর্শ। তাই পরবর্তী প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধুকে জানবার, বুঝবার এবং অনুধাবন করবার চিন্তা থেকেই আমরা বাগানিরা এই প্রতিষ্ঠানের নাম করেছি- বঙ্গবন্ধু উচ্চ বিদ্যালয়।
এই প্রতিষ্ঠানে চা শ্রমিকের সন্তানেরা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে ধারণ করে উপস্থাপন করছেন আমন্ত্রিত অতিথিদের সামনে। তাদের নিজের শৈশব স্মৃতি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, উপজাতি সংস্কৃতি খুব সুন্দর করেই তারা লালন করছেন এবং ধারণা করছেন প্রতিনিয়ত। প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান শিক্ষক রনি গোয়ালা জানান-বর্তমানে পাঠদান কার্যক্রম ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত চলছে। প্রায় দুই শতাধিক ছাত্র-ছাত্রীরা অধ্যয়ন করছেন। তিনি আরো জানান- এখন পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানটি পাঠদান কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক অনুমতি বোর্ড কর্তৃক পায়নি। বিষয়টি তারা খুব একটা ভালো বুঝেন না তাই তারা শিক্ষা বোর্ডের আনুকূল্য আশা করছেন।
সম্প্রতি এই প্রতিষ্ঠানটি দেখতে যান সিলেট বিভাগের শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক, শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান প্রধান মোহাম্মদ নুরুল হক-তিনি বলেন, এরকম একটি জায়গায়, এমন করে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা কষ্টকর ও কঠিন। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মানবিক ও উপজাতীয় কৌটায় গুরুত্বের সাথে বিবেচনা আনা দরকার। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি করতে যেকোনো রকম পরামর্শে আমি তোমাদের পাশে থাকবো। জহুর চান বিবি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ সিনিয়র সাংবাদিক আব্দুল্লাহ আল মামুন প্রতিষ্ঠানটির অবকাঠামো দেখে এবং পাঠদান কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি দেখে অভিভূত হয়েছেন। তিনি বলেন- অবশ্যই অবহেলিত, প্রান্তিক পর্যায়ের উপজাতি এই সম্প্রদায়ের প্রতি রাষ্ট্র এমনিতেই আলাদা করে মানবিক। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুকে ধারণ এবং বাগানের শ্রমিকদের নিরন্তর ও প্রাণান্তকর চেষ্টা স্বপ্নের এই প্রতিষ্ঠানটি সর্বাগ্রে পাঠদান স্বীকৃতি, এমপিওভুক্তি ও জাতীয় করণে নেয়া যেতে পারে আমি মনে করি।
যে সকল শিক্ষার্থী এখানে পড়ছেন, তারা কেউ কোনো রকম অর্থ দেননি। যে কারণে শিক্ষক যারা তারাও কোনরকম সম্মানী গ্রহণ করতে পারেন না। বাগানের উচ্চশিক্ষিত, অধ্যায়নরত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, বিনামূল্যে পাঠদান কার্যক্রম করে যাচ্ছেন। তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়-আমরা চাই, এই প্রতিষ্ঠানটি সরকারের দৃষ্টিতে আসুক। একসময় এই প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীরা বেরিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের কাজ করবে। যেটা আমরা করছি।
শত প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে, ক্রমাগত সামনে এগিয়ে চলার প্রত্যয়ে, দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছে, স্বপ্নের বাতিঘর- বঙ্গবন্ধু উচ্চ বিদ্যালয়। পিছিয়ে পড়া চা শ্রমিকের সন্তানদের জীবনমান উন্নয়নে। তাদেরকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার একটি অন্যতম উপাদান হতে পারে এই প্রতিষ্ঠানটি।
দিনের আলো কমে আসছে। অন্ধকার নেমে আসছে চারি দিকে। ঘনঘোর নীরবতা, সময় এসেছে ফিরে যাওয়ার লোকালয়। বেলা শেষে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগ মুহূর্তে মিষ্টি মুখের হাসি উজ্জল চেহারাগুলো কে চোখের সামনে নিয়ে এসে কোলাহলের শহরে চলে আসা। আর পিছনে ফিরে তাদের নিয়ে ভাবনার স্মৃতিগুলো বার বার উকি দিচ্ছি মনের মনিকোঠায়। জয় হউক বঙ্গবন্ধু উচ্চ বিদ্যালয়। জয় হউক প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের।